উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা কেন জঙ্গি তৎপরতায়?
বর্তমানে বাংলাদেশ এক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার পর দেশের মানুষ রীতিমত শংকিত –ভীত-সন্ত্রস্ত । নড়েচড়ে বসেছে প্রসাশনও। বিভিন্ন জায়গায় বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রেস্তোরা, শপিং কম্পলেক্স, মসজিদ কিছুই বাদ যায়নি। রাস্তার বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে বসেছে পুলিশি চেকপোস্ট। বাড়িতে বাড়িতে চলছে তল্লাশি।
এত এত নিরাপত্তার পরও কোন কিছুই যেন মানুষকে স্বস্তি দিতে পারছে না। কারণ দেশে রেস্তোরায় হামলা চালিয়ে বিদেশি হত্যা আর নামাজরত মুসল্লিদের উপর হামলার মতো ঘটনা বাংলাদেশের মানুষ এর আগে কখনই দেখেনি। হামলার চেয়ে হামলাকারির পরিচয় দেশের মানুষকে আরও বেশি হতবাক করেছে। আলোচনায় এসেছে দেশি বিদেশি নামিদামি কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম।
প্রশ্ন উঠেছে এই নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কেন জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ছে ? আমি আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
একসময় মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের টার্গেট করতো জঙ্গিরা। আর এখন ইংরেজি মাধ্যমের উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের। কেন ?? কারণ নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের জঙ্গি তৎপরতায় জড়ানোর মাধ্যমে জঙ্গিরা সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করতে চায় । তাদের উগ্রবাদী লক্ষ্যকে আরো ফলপ্রসু করতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠছে।
মূলত নিজেদের সুবিধার্ জন্য জঙ্গি সংগঠনগুলো এদের পরকালের কথা বলে, আধ্যাত্মিক প্রলোভন দেখিয়ে জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত করছে। দেশি হোক আর আর্ন্তজাতিক সংগঠন –ই হোক যেকোন জঙ্গি সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ই থাকে মানুষের মধ্য আতংক সৃষ্টি করা। অতীতে মাদ্রাসা বা সাধারণ মানের স্কুল কলেজের ছাত্রদের ব্যবহার করে তাদের উদ্দেশ্য ভেস্তে যাবার পরে এবার উগ্রবাদ বাস্তবায়নে নতুন নীল-নকশা তৈরি করছে জঙ্গি সংগঠনগুলো।
সমাজের সর্বস্তরে আতংক আর উৎকন্ঠা সৃষ্টি করার মাধ্যমে কথিত খেলাফত বাস্তবায়নই তাদের মূল লক্ষ্য । আর সেকারণেই এসব হামলার জন্য উচ্চবিত্ত পরিবারের নামিদামি প্রতিষ্ঠানের সন্তানদের রিক্রুট করা হচ্ছে।
এছাড়া হুরপরীর স্বপ্ন দেখিয়ে মাদ্রাসার এতিম ছেলেদের বিদেশি হত্যার জন্য তাদের কাছে যথাযথ মনে হয়নি। তাই এবার মোগজধোলাই দেয়া হয়েছে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের। এর মূল কারণ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া এসব উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেদের প্রভাবিত করা তুলনামুলকভাবে বেশ সহজ।
ছোটবেলা থেকেই এরা বেশ আদরেই বড় হয়। ফলে একদিকে পরনির্ভরশীলতা অন্যদিকে কষ্ট সহিষ্ণুতার অভাবে পরিণত বয়সে ছোট খাট দুঃখ কষ্টও এদের বিষাদগ্রস্থ করে তোলে। সেটা হতে পারে সহপাঠীর আচরণ, প্রেমে ব্যর্থতা, রেজাল্ট খারাপ, পারিবারিক সমস্যা ইত্যাদি। সবকিছুই তারা তৈরি চায়, কোন ব্যর্থতার দুঃখ-ই যেনো এরা মেনে নিতে পারে না। আর অবসাদগ্রস্ত এসব তরুণ সবসময় শান্তির খোঁজ করে। কেউ কেউ নেশায় জড়িয়ে যায়, কেউ কেউ অস্থির জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়ে । পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় নয় বলে বেশিরভাগই এই অবস্থা থেকে উঠে আসতে পারে না।
আর এসময় যদি কেউ তাদের শান্তির ধর্ম ইসলামের দাওয়াত দেয় ? ইসলামের ভুল ব্যখ্যা দিয়ে তাদের মনোজগতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে তবে সেটা খুব সহজ হয়ে যায় । এক্ষেত্রে শিক্ষা ব্যবস্থাও দায়ি বহুয়াংশে। এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক মূল্যবোধ ও শিষ্টাচার শিক্ষা নেই বললেই চলে । উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে নৈতিকতাহীন পুঁথিগত বিদ্যা এসব কোমলমতিদের অন্তর ছুঁতে পারে না । তাই এর কোন প্রভাবও পড়েনা তাদের চরিত্র গঠনে।
করনীয় কি আর বর্জনীয় কি সেই বিষয়গুলোর সিদ্ধান্ত নিতে এসব পুঁথিগত বিদ্যা কোনো কাজে আসে না। অন্যদিকে ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্ম বিষয় টি অবহেলিত থাকায় শিক্ষার্থিদের নিজ ধর্মের তৎপর্যপূর্ণ শিক্ষা বা মর্মবানী সম্পরকে জানার সুযোগ কম থাকে। নিজ ধর্ম সম্পকে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকায় তাদের যা বোঝানো যায় তাই তারা গ্রহণ করে। সেকারণে কোরআনের যেকোনো আয়াতের ভুল ব্যখ্যা দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করে উগ্রবাদি বানানো সম্ভব হয় সহজেই। অথচ প্রতিটি ধর্মই সৃষ্টি হয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য।
পরিশেষে বলা যায়, জঙ্গিবাদের কারণে দেশ আজ আতংকিত -উৎকন্ঠিত। অনেকের মনে এখন একটাই প্রশ্ন , জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের তৎপরতায় কী সফলতা পেয়েছে ? নাকি আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সফল হয়েছে? আমি সে বির্তকে যাচ্ছি না। শুধু এতটুকু বলবো, রেস্তোরায় হামলার পর থেকে রেস্তোরাগুলো ফাঁকা, ৫০% ডিসকাউন্ট দিয়েও রেস্তোরাগুলো কাস্টমার আনতে পারছেনা। শোলাকিয়ায় হামলা তো নামাজের সময় হয়েছিল, তবে কি মানুষ মসজিদে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে ? এই ঈদ- উল- ফিতরের ছুটিতে বাড়ি ফেরার সময় শুধু সড়ক দুঘটনায় মারা গেছে ১৮২ জন। তাই বলে কি কেউ কোথাও যাওয়া বন্ধ করেছে ? না করেনি।
দেশের নাগরিক হিসাবে আমাদের উচিত কোনো রকম সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে প্রশ্রয় না দিয়ে তাদের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া । এছাড়া আতঙ্কিত না হয়ে, বরং নিজেদের ছেলে মেয়েদের ইসলামের প্রকৃত মর্ম সম্পকে সচেতন করা , যাতে তাদের কেউ বিভ্রান্ত ও প্রভাবিত করতে না পারে। মূলত ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও সচেতণতাই সন্ত্রাসবাদের হাত থেকে মুক্তি দিতে পারে সমগ্র বাঙালী জাতিকে।
তারানা শারমিন মাহমুদ
সাবেক শিক্ষার্থী , নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়